পবিত্র ঈদ উল ফিতর মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। খুশি ও আনন্দের দিন। শুধু নেকার বান্দাদের জন্যই খুশির দিন ।যারা এক মাস রোজা রেখেছেন তাদের জন্য ঈদ-উল-ফিতর আনন্দ ও উদযাপনের দিন। এই দিনটিও আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের দিন। রমজানের বরকত অর্জনের জন্য ত্যাগ, কষ্ট ও প্রচেষ্টার পর ঈদ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে অনন্ত খুশি ও আনন্দ।
কিভাবে শুরু হয় ঈদুল ফিতর
ঈদ উল ফিতর (عيد الفطر) এর ঈদ শব্দটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা। আর ফিতর শব্দের অর্থ হলো, ফাটল, ভেঙ্গে ফেলা, বিদীর্ণ করা। এই দিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয় কারণ দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে রোজা ভঙ্গ হয় এবং রোজা ছেড়ে দেওয়া হয়।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, প্রতি বছর মুশরিকদের জন্য দুটি দিন ছিল যেদিন তারা উদযাপন করত। যখন রাসুল (সা.) মদিনায় আগমন করলেন, তখন তিনি বললেন, তোমাদেরকে ঐ দুটি উৎসবের চেয়ে উত্তম আনন্দের দু’টি দিন দেওয়া হয়েছে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। (সুনানে নাসাঈ: ১ম খ-, পৃ. ১৭৭; সুনানে আবু দাউদ ১ম খ-, পৃ. ১৬১, হাদিস নম্বর-১১৩৬)
ঈদুল ফিতরের করনীয় ও তাৎপর্য
ঈদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর সমবেদনা প্রকাশ করুন এবং তার কৃতজ্ঞ হও।’ (বাকারা-১৮৫)
হযরত মুহাম্মদ সা. তিনি বলেন, যখন ঈদুল ফিতরের দিন আসে, তখন আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করেন এবং ফেরেশতাদের বলেন, হে আমার ফেরেশতারা, রোজাদারদের বলুন, তারা কি এই দিনে রোজা রাখার সওয়াব পেতে পারে? ” যারা রোজাদার তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালন করে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, হে দয়াময় আল্লাহ, তাদের উপযুক্ত ও উত্তম প্রতিদান দিন। কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস রোজা রেখেছে, তাদের যথাযথ প্রতিদান দাও।
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের বলতে থাকেন, হে আমার বান্দাগণ, তোমরা যারা সঠিকভাবে রোজা রেখেছ এবং তারাবীহ নামায আদায় করেছ, ঈদের নামায পড়ার জন্য দ্রুত ময়দানে ঈদগাহে যাও এবং তোমাদের সওয়াব গ্রহণ কর। ঈদের নামায শেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দাগণ, এই দিনে আমি তোমাদের সকল গুনাহকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। অতএব, নির্দোষ হয়ে ঘরে ফিরে যাও। (বায়হাকী ও মিশকাত)
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন নির্ধারণ করেছেন। এর একটি ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি ‘ঈদুল আযহা’। তোমরা পবিত্রতার সাথে এই দুটি উৎসব পালন করবে।” (আবু দাউদ ও নাসাঈ)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এই দিনে রোজা রাখবেন না। এই দিনটি আপনার জন্য আনন্দ এবং উদযাপনের দিন। পরিবারের সাথে খাওয়া, পান এবং আনন্দ করার দিন। আল্লাহর স্মরণের দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনু হিব্বান)
রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘ঈদের আনন্দ কেবল তাদের জন্য যারা রোজা ও তারাবীহ নামাজ সহ আল্লাহ তায়ালার সকল নিয়ম-কানুন গুরুত্বের সাথে পালন করেছে। আর যারা রমজানে রোজা ও তারাবীহ রাখেননি, তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ ও আনন্দ আগুনের সমতুল্য। (বুখারী)
ঈদ উল ফিতরের আমল
ঈদুল ফিতর এর দিন আমাদের কিছু করার আছে। যা ঈদকে আরও পরিপূর্ণ করে তোলে। ঈদুল ফিতরের প্রথম সুন্নত হলো শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা থেকে ঈদের নামায পর্যন্ত তাকবীর দেয়া।
দ্বিতীয়টি হল ঈদের নামাযের আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা।
তৃতীয়ত, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা- মেসে হাঁটা-গোসল করা- সম্ভব হলে নতুন বা ভালো পরিষ্কার জামাকাপড় পরা- পারফিউম ব্যবহার করা।
চতুর্থত, ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে মিষ্টিমুখ করে বের হওয়া।
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। অন্য বর্ণনায় আনাস (রা.) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি তা বিজোড় সংখ্যায় খেতেন। (সহীহ বুখারী-৯৫৩)
পঞ্চমটি হল, সম্ভব হলে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া এবং ঈদের নামাযের জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করা। এটি অনেক লোকের সাথে দক্ষতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে।
ষষ্ঠত, ঈদগাহে যাওয়ার সময় প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া (যদিও আমাদের দেশে এটা প্রচলিত নয়, মহিলাদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই)।
উম্মে আতিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আমাদেরকে ঈদের দিন বের হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এমনভাবে আমরা কুমারী ও ঋতুমতী মেয়েদের ভেতরের দরবার থেকে বের করে দিতাম। তারা পুরুষদের পিছনে অবস্থান করবে এবং তাকবীর বলবে এবং তাদের সাথে দুআ করবে – তারা সেদিনের বরকত ও পবিত্রতার আশা করত।(সহীহ বুখারী ৯৭১)
সপ্তম হলো ঈদের সালাত আদায় করা এবং খুতবা শোনা। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিনে সালাত আদায় করতেন এবং সালাতের পর খুতবা দিতেন। (সহিহ বুখারি – ৯৫৭)
অষ্টমটি হলো দক্ষতা বিনিময়। একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানো একটি সুন্দর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
হাফেজ ইবনে হাজার (রা.) বলেন, জুবায়ের ইবনে নাফির (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণ ঈদের দিন একে অপরকে বলতেন: “আল্লাহ আমাদের এবং তোমাদের নেক আমলগুলো কবুল করুন। ” (আল মুজামুল কাবির লিত তাবারি : ১৭৫৮৯)
সদকায়ে ফিতর প্রদান করা
মুসলমানরা ঈদের দিনে গরীব বা অভাবীকে অর্থ প্রদান করে, যাকে ফিতরাহ বলা হয়, রমজান মাসে রোজা রাখার ভুলগুলি পূরণ করার জন্য। তা আদায় করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী- ‘তুহরাতুল্লিস সায়্যিম’ অর্থাৎ এক মাসের সিয়াম, মুমিনের অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটির কাফফারা হলো সদকায়ে ফিতর।
ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলবশত নামাজ পড়লেও ফিতরা আদায়ের নির্দেশ রয়েছে ইসলামে।
সাদাকাতুল ফিতর সম্পর্কে হাদিসে পাঁচ ধরনের খাদ্যের কথা বলা হয়েছে: গম, যব, খেজুর, কিসমিস, পনির।
সাদাকায় ফিতরের গুরুত্ব সম্পর্কে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন- “নিশ্চয়ই যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে সে সফলকাম হবে।” (সূরা আলা: আয়াত ১৪)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাস, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, যুবক, বৃদ্ধ সকল মুসলমানের ওপর যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। এবং (ঈদের) নামাযের আগে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়
হাফেজ ইবনে হাজার রহ. তিনি বলেন, যুবাইর ইবনু নাফির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম একে অপরকে বলতেন।, تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَم (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম)। অর্থ: আল্লাহ তায়ালা আমাদের এবং আপনার নেক আমলগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী ৬/২৩৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী, হাদীস-৬৫২১)
আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: কোনো মুসলমানের জন্য তিন দিনের বেশি তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক বর্জন করা বা ছিন্ন করা বৈধ নয়। তাদের অবস্থা এমন যে, দেখা হলে একজন আরেকজনকে এড়িয়ে যায়। এই দুইয়ের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয় সে শ্রেষ্ঠ।
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর
আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে মা ও বাবাই উত্তম আচরণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি হকদার। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্য আত্মীয়। ঈদ হলো আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সকল প্রকার মানসিক অপবিত্রতা দূর করার একটি বড় সুযোগ ঈদ উল ফিতরে। কেননা আত্মীয়দের সাথে হিংসা ও খারাপ সম্পর্ক এমন একটি বিষয় যা মানুষকে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা থেকে দূরে রাখে। হাদিসে এসেছে
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন: “সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সেদিন সকল বান্দাকে ক্ষমা করা হয়, একমাত্র আল্লাহর সাথে শিরককারী ব্যতীত। কিন্তু সেই দুই ভাইকে ক্ষমা করা হয় না যাদের মধ্যে শত্রুতা ও কলহ থাকে। তখন (ফেরেশতারা) )কে বলা হয়: তাদের উভয়কে তাদের মতভেদ মীমাংসা করতে এবং একত্রে মিশে যেতে ছেড়ে দিন!
তাদের মতভেদ মীমাংসা করতে এবং একত্রে মিশে যাওয়ার জন্য এই দুটিকে ছেড়ে দিন! তাদের মতভেদ মীমাংসা করতে এবং একসাথে মিশে যেতে এই দুটিকে ছেড়ে দিন!!! (তারপর তাদেরও ক্ষমা করা হবে)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, নিজেদের মধ্যে হানাহানি, বিবাদ, বিবাদ রাখা এত বড় অপরাধ যার কারণে আল্লাহর সাধারণ রহমত ও বিশেষ ক্ষমাকে অস্বীকার করতে হয়। হাদীসে আরো আছে।
পরিশেষে বলা যায়, ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তার জীবনের ধর্মীয় কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা অপরিহার্য।
আরো পড়ুন>>রমজানের ফজিলত – আমল ও তাৎপর্য