Site icon

কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী

ইসলামের আলোকে কুরবানীর ইতিহাস ও ফাজিলত

কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য ।কোরবানি হল একটি মুসলিম উপাসনা যা প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে ধনীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর এই ইবাদতের মাধ্যমে মুসলমানরা

সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি মহান আল্লাহর নির্দেশ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী করা উচিত, তবেই

তা মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকে আজ অবধি প্রতিটি প্রাণী তার প্রিয় মানুষ বা প্রিয় সত্তার সান্নিধ্য লাভের জন্য বা তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত

জিনিসগুলিকে বিসর্জন দিয়ে মানব ইতিহাসে তার অকৃত্রিম ভালবাসা এবং আবেগকে অমর করে রেখেছে।

কখনো সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের এই অকৃত্রিম উৎসর্গ, আবার কখনো বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের জীবন উৎসর্গ যেন এক বিরল দৃষ্টান্ত। কুরবানীর ইতিহাস অতি প্রাচীন।

প্রথম পিতা আদম (আ.)-এর সময় থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা

মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি।

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা বলেন,  অর্থাৎ, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল,

তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, ‘আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল,

‘আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন। [সূরা মায়িদা (৫):২৭]।

কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য মূল ঘটনা হলো

যখন আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাদের সন্তানদের জন্ম ও বংশবৃদ্ধি শুরু হয়,

তখন হাওয়ার (আ.) এক জোড়া যমজ (যময়া) অর্থাৎ একটি পুত্র এবং একটি কন্যা প্রতিটি গর্ভ থেকে

একসাথে জন্মগ্রহণ করে। শীস ব্যতীত। কারণ সে একা জন্মেছে। তখন আদমের ভাই-বোন ছাড়া আর কোনো সন্তান ছিল না।

কিন্তু ভাই-বোন একে অপরকে বিয়ে করা যাবে না। অতএব, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা বর্তমান প্রয়োজনের জন্য আদম

(আ.)-এর শরীয়তে একটি বিশেষ আদেশ জারি করেছেন যে একই গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া যমজ

পুত্র ও কন্যাকে ভাই-বোন হিসাবে গণ্য করা হবে।

তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া পুত্রের ক্ষেত্রে প্রথম গর্ভ থেকে জন্ম না নেওয়া কন্যাকে বোন হিসেবে গণ্য করা হবে না।

তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। সুতরাং সে সময় আদম (আ.) একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবীলের

সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম ছিল আকলিমা। কিন্তু হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না।

সে ছিল কুশ্রী ও কদাকার। তার নাম ছিল লিওযা। বিবাহের সময় হলে শরয়ী ‘নিয়মানুযায়ী হাবীলের সহোদরা কুশ্রী বোন কাবীলের ভাগে পড়ল।ফলে আদম (আ.) তৎকালীন শরীয়তের

আইনের পরিপ্রেক্ষি তে কাবীলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তার নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন।

তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিল না।

অবশেষে আদম (আ.) তার এ দু’সস্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন,  কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর,

যার কুরবানী গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।’ সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীকে

ভষ্মীভূত করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবুল হতো না তারটা পড়ে থকত।  

ফতহুল ক্বাদীরের বর্ণনায় পাওয়া যায়

যে, হাবীলের পেশকৃত দুম্বাটি জান্নাতে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তা জান্নাতে বিচরণ করতে থাকে।

অবশেষে ইসমাঈল যাবিহুল্লাহ (আ.) কে ঐ দুম্বাটি পাঠিয়ে বাঁচিয়ে দেয়া হয়।]

আর কাবীলের কুরবানী যথাস্থানেই পড়ে থাকল। অর্থাৎ হাবীলেরটি গৃহীত হলো আর কাবীলেরটি হলো না।

কিন্তু কাবীল এ আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না।

এ অকৃতকার্যতায় কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না

এবং প্রকাশ্যে তার সে তার ভাইকে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব।

তখন আবেল উত্তরে রাগ না দেখিয়ে একটি মার্জিত এবং নীতিগত বক্তৃতা করেছিলেন, কেইন

এর প্রতি তার সহানুভূতি এবং শুভেচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। হাবীল বলেন,

তিনি মুত্তাকীরের আমল কবুল করেছেন।

সুতরাং তুমি তাক্বওয়ার কর্মই গ্রহণ করো। তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করলে তোমার কুরবানীও গৃহীত হতো। তুমি তা করোনি, তাই তোমার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

এতে আমার দোষ কোথায়?…..তবুও এক পর্যায়ে কাবীল হাবীল কে হত্যা করে ফেলল। (তাফসীর ইবনু কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩/৪৫ ও ফতহুল ক্বাদীর, ২/২৮-২৯)

কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য । কুরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে।

এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কুরবানী দাতা ‘হাবীল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা

কুরবানী হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কুরবানী কবুল হয়।

 পক্ষান্তরে কাবীল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কুরবানী কবুল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো কুরবানী মনের ঐকান্তিক

আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। আল্লাহ তা’আলা বলেন, অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি,

যাতে তারা পশু কোরবানি করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে, কারণ তিনি তাদের জন্য চার পায়ের পশু থেকে জীবিকা নির্ধারণ করেছেন। [সূরা হজ (22):34]।

কোরবানির ফজিলত কী? 

কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও সুন্দর উত্তর দিয়েছেন।

হাদীসটি হযরত যায়েদ ইবনে (রা) থেকে বর্ণিত। কি আছে সেই হাদীসের বর্ণনায় ।

একদিন সাহাবায়ে কেরামগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী কি?

 

একদিন সাহাবায়ে কেরামগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী কি?

জবাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা তোমার পিতা হজরত ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর সুন্নাত। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো,

হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটা কি আমাদের পুণ্য (ফযিলত রয়ছে)? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বললেন, (কুরবানীর পশুর)

প্রতিটি চুলের পরিবর্তে (একটি) কল্যাণ রয়েছে।

তারা আবার জিজ্ঞেস করল, পশম দিয়ে পশুর কি হবে? (প্রাণীদের অনেক পশম থাকে)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পশমযুক্ত পশুর প্রতিটি

পশমের জন্য একটি করে নেকী রয়েছে।” (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত) আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখে উট, গরু-মহিষ

ও ছাগল-ভেড়া কোরবানি করা। এবং এই প্রাণীটির যত পশম থাকুক না কেন, প্রতিটি পশমের জন্য একটি করে সয়াব রয়েছে।

মুসলিম উম্মাহ একমত যে কোরবানি কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী করা হয়। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

কিন্তু কুরবানী করা ওয়াজিব নাকি সুন্নত এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।

এ কারণেই অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ও সংস্কারকদের অভিমত যে, সম্পদের মালিকের জন্য কুরবানী ওয়াজিব।

আবার অনেক সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী এবং ইসলামী পন্ডিতগণ কুরবানীকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলে অভিহিত করেছেন।

সামর্থ্য

সামর্থ্য থাকলে কুরবানী না করাই মুসলিম উম্মাহর জন্য উত্তম। সম্ভব হলে নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী করুন। যার মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ মানা হয়,

তাই সাহাবায়ে কেরামকে অনুসরণ ও অনুকরণ করাও বিরাট সওয়াব।

মনে রাখতে হবে (কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য) কুরবানী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি

অর্জনের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে।

হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের  সুন্নত হিসেবে জাগ্রত। আবার ইসলামের ইঙ্গিত প্রকাশ পায়।

এমনটা হওয়া উচিত নয়জে না করে হজের টাকা দান করলে ওয়াজিব হয় না।

অনুরূপভাবে কোরবানির টাকা গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করলেও কোরবানির হক আদায় হবে না।

কেননা কুরবানীতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা ইসলামের

ইবাদত ও দ্বীনের নিদর্শন ও প্রতীক। 

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন:

কুরবানী হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত এবং সমগ্র মুসলিম জাতির একটি অভ্যাস।

আর কোথাও বলা হয়নি যে, তাদের কেউ কুরবানীর পরিবর্তে সাদাকা দিয়েছে।

আর ভালো হলে তারা এর ব্যতিক্রম করতেন না।’ (ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া)

তাই কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী টাকা দিয়ে নামাজ ও কোরবানি করা উচিত নয়।

এর একটি প্রমাণ হলো- হজের ক্ষেত্রে যারা তামাত্তু ও কিরান হজ করেন, তারা কুরবানীর

পরিবর্তে তিন গুণ বা তার বেশি সাদাকাহ দিলে তা পরিবর্তন হবে না। কোরবানিও তাই।

আর আল্লাহই ভালো জানেন।’ (তুহফাতুল মওদুদ) কুরবানীর নামাজের মতো ব্যক্তিগত ইবাদত।

কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী কুরবানীর ফজিলত ও সওয়াব অনেক।

আর এটা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নত হওয়ায় প্রিয়নবী নিজেই তা পালন করেছেন।

তাই মুহাম্মাদী উম্মাহর সামর্থ্যবানদের জন্য তা পালন করা ওয়াজিব।

কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য আলোচনা করা হলো ।

আরো পড়ুন>>ঈদুল আজহা এর উৎপত্তি ও শিক্ষা

Exit mobile version